জর্জ ম্যালিয়েসঃ বিশ্ব চলচ্চিত্রের এক অনন্য জাদুকর
অস্কারে মনোনয়ন পাওয়া সিনেমা “হিউগো” (Hugo) দেখছিলাম। এক মা-বাবা হীন এক
বাচ্চার কাহিনী। বাচ্চাটি একা একা রেল স্টেশনে থাকে এবং ক্লক টাওয়ারের ঘড়িগুলোকে নিয়মিত
পরিচর্যা করে সচল রাখে। কিন্তু দেখতে দেখতে সিনেমাটি আরেকজনের গল্প হয়ে গেল। জর্জ ম্যালিয়াস
নামক এক ষাটোর্ধ খেলনা বিক্রেতা যার ওই স্টেশনেই একটা দোকান আছে। পরবর্তীতে জানা যায়
সেই ভদ্রলোক সিনেমা বানাতেন এবং প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় বিভিন্ন কারণে তিনি নিঃস হয়ে
পড়েন। তার সব সিনেমা হারিয়ে যায়, যার বেশিরভাগই জুতোর হিল তৈরির জন্য গলিয়ে ফেলা হয়।
আমি তখন পর্যন্ত জর্জ ম্যালিয়েস কে চিনতাম না, জানতাম না যে তিনি কি শুধুই একটি ফিকশনাল
চরিত্র নাকি সত্যিকারের। পরে ইন্টারনেটে ঘাটাঘাটি করে জানলাম এক অদ্ভুত জাদুকরের কথা
যিনি তার মেধাতে তার সময়ে সবাইকে ছাড়িয়ে অনেক দূরে পৌঁছে গিয়েছিলেন। আসুন ম্যালিয়েস
সম্পর্কে কিছু কথা জানি।
জন্ম এবং স্বপ্নের দিকে চলা
ম্যারি জর্জ জিন ম্যালিয়েস (Marie-Georges-Jean Méliès) ১৮৬১ সালে ফ্রান্সের
প্যারিসে জন্মগ্রহণ করেন। ১৮৮০ সালে তিনি তার গ্র্যাজুয়েশন শেষ করেন এবং পারিবারিক
জুতার ব্যবসায় প্রবেশ করেন। সরকারিভাবে তিন বছর বাধ্যতামূলক মিলিটারি প্রশিক্ষণ শেষে
তার বাবা তাকে এক পারিবারিক বন্ধুর কাছে কাজ করতে লন্ডন পাঠান। লন্ডনে থাকা কালেই ম্যালিয়েস
স্টেজ জাদুর প্রতি আকর্শিত হন। সেখান থেকে ১৮৮৫ সালে তিনি ফ্রান্সে ফিরে আসেন এবং ছবি
আঁকতে শুরু করেন। কিন্তু তার বাবা তাকে আর্টের জন্য আর্থিক সাহায্য না করায় তিনি আবার
পারিবারিক ফ্যাক্টরিতে ম্যাশিন সুপারভাইজর হিসেবে কাজ শুরু করেন। এরপর তিনি পারিবারিক
এর বন্ধুর মেয়েকে মোটা যৌতুকের বিনিময়ে বিয়ে করেন। কিন্তু জাদুর প্রতি তাঁর আগ্রহ থেমে
থাকেনি। তিনি কাজের ফাঁকে ফাঁকে রবার্ট-হুডিন এর জাদু দেখতে যেতেন এবং এমিল ভইসিন এর
কাছে জাদু শিখতে থাকেন। এমিল তাঁকে প্রথম স্টেজ এ জাদু দেখানোর সুযোগ করে দেন। ১৮৮৮
তে তাঁর বাবা অবসর গ্রহণের পর তিনি পারিবারিক ব্যবসায় তাঁর শেয়ার ভাইদের কাছে বিক্রি
করে দেন এবং সেই টাকা ও স্ত্রীর যৌতুকের টাকা দিয়ে তাঁর স্বপ্নের “থিয়েত্রে রবার্ট-হুডিন”
কিনে নেন। পরবর্তী ৯ বছর ধরে তিনি প্রায় ৩০ টি নতুন জাদু তৈরি করেন। তিনি শুধু যে জাদু
দেখাতেন তাই নয় বরং জাদুর সাথে হাস্যরস এবং উপস্থাপনায় ভিন্নতা নিয়ে আসেন। সেই সময়
তিনি পত্রিকায় রাজনৈতিক কার্টুনও আঁকতেন। তাঁর থিয়েটার এর উত্তরোত্তর উন্নতির সাথে
সাথে তিনি বিখ্যাত জাদুকরদের তাঁর থিয়েটার এ নিয়ে আসেন। জাদুর মাঝে তিনি অনেক ধরনের
স্পেশাল ইফেক্ট যোগ করেন। ১৯৯৫ সালে তিনি জাদুকর সমিতির প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন।
সিনেমা বানানোর শুরু
১৮৯৫ সালের ২৮শে ডিসেম্বর প্যারিসে লুমিয়ের ব্রাদার্সের প্রথম চলচ্চিত্রের
প্রদর্শনীতে ম্যালিয়েস উপস্থিত ছিলেন। চলমান সেই ছবি তাকে চরমভাবে আকর্ষণ করে এবং তিনি
লুমিয়ের ভাইদের সেই ছবি তোলার ক্যমেরার জন্য ১০,০০০ ফ্রাঙ্ক দেয়ার প্রস্তাব করেন। লুমিয়ের
ভাইয়েরা সেই প্রস্তাব ফিরিয়ে দিলে তিনি নিজেই ক্যামেরা তৈরির কাজে লেগে পড়েন। ১৮৯৬
সালে ম্যালিয়েস তাঁর মেকানিক সহাকারীদের সাহায্যে তাঁর অটোমেটন (হিউগো ছবিতে দেখানো
হয়েছে) ও স্পেশাল ইফেক্টের যন্ত্রপাতির সাহায্যে এক ধরনের ক্যামেরা বানাতে সক্ষম হন
এবং সেপ্টেম্বরে তিনি এটার প্যাটেন্ট করান “কিনেটোগ্রাফ রবার্ট-হুডিন” নামে। প্যাটেন্ট
করানোর আগেই তিনি তার প্রথম ছবির শ্যুটিং করেন মে মাসে যা আগস্টে তিনি তাঁর থিয়েটারে
প্রদর্শন করেন। তাঁর প্রথম ছবি “প্লেয়িং কার্ড” তিনজন লোকের কার্ড খেলার দৃশ্য এক মিনিট
ধরে দেখানো হয়েছে। ১৮৯৬ সালেই ম্যালিয়েস মোট ৭৮ টি ছবি বানান এবং ১৮৯৭ সালে ৫৩ টি।
তাঁর উল্লেখযোগ্য কাজের মধ্যে জোয়ান অব আর্ক, আ ট্রিপ টু দ্য মুন (বিশ্বের
প্রথম সায়েন্স ফিকশান সিনেমা), দ্য হন্টেড ক্যাসল (বিশ্বের প্রথম হরহ সিনেমা), হাউজ
অব দ্য ডেভিল, গালিভার্স ট্রাভেলস, দ্য ওয়ান ম্যান ব্যান্ড ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। তিনি
তাঁর জীবদ্দশায় ১৮৯৬ থেকে ১৯১৩ সাল পর্যন্ত ৫৩১ টি সিনেমা বানান যাদের ব্যাপ্তি ৪০
সেকেন্ড থেকে শুরু করে ৪০ মিনিট পর্যন্ত ছিলো।
ম্যালিয়েসের চলচ্চিত্র সম্পর্কে
ম্যালিয়েসের চলচ্চিত্র সম্পর্কে আসলে বলা শুরু করলে শেষ করতে কষ্ট হয়ে যাবে।
যে সময় সিনেমা বানানোর জন্য ভালো কোন ক্যামেরাই ছিলো না সে সময় সিনেমায় স্পেশাল ইফেক্ট
ব্যবহার করে তিনি সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন। আমি চিন্তা করি এখনকার যুগে হলে তিনি
আসলে কি করতেন। প্রথম দিকে তার সিনেমাগুলোয় তেমন কোন কাহিনী ছিলো না। মূলত দর্শক ধরার
জন্য তিনি লুমিয়ের ভাইদের সিনেমাগুলোকে পুনঃনির্মান করতেন বা অনুকরণ করতেন। কিন্তু
দ্য ওয়ান ম্যান ব্যান্ড দিয়ে সবার দৃষ্টি কাড়েন। একই সাথে সাত জন ব্যক্তির চরিত্রে
তিনি একাই অভিনয় করেন। একই ফ্রেমে একই মানুষ ৭টি চরিত্রে অভিনয় করা যে সম্ভব সেটা তিনিই
প্রথম দেখান। এখন যে আমরা একজন ব্যক্তিকে দ্বৈত চরিত্রে অভিনয় করতে দেখি সেটা প্রথম
ম্যালিয়েস ই করে দেখিয়েছেন। আগেই বলেছি তিনি অনেক নতুন কিছুর পথপ্রদর্শক ছিলেন যেমন,
প্রথম রঙ্গীন সিনেমা, প্রথম সায়েন্স ফিকশন, প্রথম হরর সিনেমা, প্রথম স্পেশাল ইফেক্ট
এর ব্যবহার ইত্যাদি।
দূঃখের বিষয় হলেও সত্যি এই চলচ্চিত্র জাদুকরের বেশিরভাগ ছবিই হারিয়ে গেছে।
৫৩১ টি ছবির মধ্যে মাত্র ২০০টির মত পাওয়া গেছে। ইউটিউব এর এই লিঙ্ক এ আপনারা ১৯৩ টি ছবি পাবেন ম্যালিয়েস এর
বানানো। সবাইকে অনুরোধ করব ছবিগুলো দেখতে।
এ ট্রিপ টু দ্য মুন ছবির একটি দৃশ্য
শেষ জীবন
১৯১০ সালে পাথে এর সাথে করা চুক্তি ম্যালিয়েস এর ফিল্ম ক্যারিয়ার ধ্বংশের
প্রধান কারণ ছিল। তিনি পাথে এর কাছ থেকে অনেক টাকা লোন নেন ছবি বানানোর জন্য এবং তার
স্টুডিও ও ঘর বন্ধক রাখেন। পাথে তার ছবি বিতরণের সত্ত্ব ও নিয়ে নেয়। ১৯১৩ সালে পাথে
এর সাথে চুক্তি ভেঙ্গে দেন এবং পাথে এর দেনা মেটাতে গিয়ে তিনি নিঃস হয়ে পড়েন। পাথে
এর সাথে রাগ করে তিনি তার অনেকগুলো ছবির নেগেটিভ পুড়িয়ে ফেলেন। ১৯২০ সালের মাঝামাঝি
তিনি প্যারিস এর একটি স্টেশনে চকলেট ও খেলনা বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করতে থাকেন।
১৯২৫ সালে তার অনেক দিনের সহকারী জীন ডেলসি কে বিয়ে করেন। তিনি বলতে গেলে পুরোপুরি
হারিয়ে যান সবার কাছ থেকে। বিশের দশকের শেষের দিকে কিছু সাংবাদিক তার কাজ নিয়ে গবেষণা
শুরু করায় তিনি আবার মানুষের সামনে আসতে থাকেন। তিনি চলচ্চিত্র সমাজে সমাদের পেতে শুরু
করেন। ১৯২৯ সালে তার জীবন কর্ম নিয়ে একটি অনুষ্ঠান হয় যেখানে তাকে সম্মান জানানো হয়।
তাঁর মতে সেটি ছিল তাঁর জীবনের সেরা মুহূর্তগুলোর একটা। ১৯৩২ সালে চলচ্চিত্র সমিতি
তাঁর থাকার জন্য একটি ঘর দেন। ১৯৩৭ সালে তিনি খুব অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং ১৯৩৮ সালের ২১
জানুয়ারী এই মহান চলচ্চিত্র নির্মাতা শেষ নিঃশাষ ত্যাগ করেন।
অন্যান্যঃ
উইকিপিডিয়া থেকে ম্যালিয়েস এর সিনেমার একটি লিস্ট দিলামঃ
• Playing Cards (1896)
• The Haunted Castle (1896)
• Batteuse à vapeur (1896)
• Bébé et fillettes (1896)
• Le Bivouac (1896)
• The Vanishing Lady / Escamotage d'une dame chez
Robert Houdin (1896)
• The House of the Devil / Le Manoir du diable
(1896)
• Boulevard des Italiens
• Cleopatra (1899)
• Cinderella / Cendrillon (1899)
• The Dreyfus Affair / L'Affaire Dreyfus (1899)
• Jeanne d'Arc (1900)
• A Trip to the Moon / Le Voyage dans la lune (1902)
• The Man With The Rubber Head / L'Homme à la tête de
caoutchouc (1902)
• Gulliver's Travels / Le Voyage de Gulliver à Lilliput et chez les Géants (1902)
• The Inn Where No Man Rests / L'Auberge du Bon
Repos (1903)
• The Mystical Flame / La Flamme merveilleuse (1903)
• Faust in Hell (1903)
• Kingdom of the Fairies / Le Royaume des fées (1903)
• The Impossible Voyage / Voyage à travers l'impossible (1904)
• The Adventurous Automobile Trip (1904)
• Hilarious Posters / Les Affiches en goguette
(1905)
• Palace of the Arabian Knights / Le Palais des
Mille et une Nuits (1905)
• Paris to Monte Carlo / Le Raid Paris-Monte Carlo
en deux Heures (1905)
• The Mysterious Retort / L'Alchimiste Parafaragamus
ou La Cornue infernale (1906)
• 20,000 Leagues Under the Sea / 20.000 Lieues sous
les mers (1907)
• Humanity Through the Ages (1908)
• Conquest of the Pole / A la conquête du pôle (1912)
• Baron Munchausen's Dream / Les Hallucinations du
baron de Münchausen (1911)
• The Ranchman's Debt of Honor (1911 - USA)
• The Knight of the Snows / Le Chevalier des Neiges
(1912)
• Cinderella or The Glass Slipper / Cendrillon ou La
Pantoufle mystérieuse (1912)
• The Ghost of Sulpher Mountain (1912 -USA)
• The Prisoner's Story (1912 - USA)
• Le Voyage de la famille Bourrichon (1913)
এটি সম্পুর্ণ লিস্ট নয়। তাঁর বিখ্যাত কাজগুলোর লিস্ট এটি। এছাড়াও তার অন্যান্য
কাজ সম্পর্কে জানতে উইকিপিডিয়া দেখতে পারেন।
Comments
Post a Comment